যেনে নিন ভয়ংকর কৌশল কি ফিরিয়ে আনবে যুক্তরাষ্ট্র? - History VS Story

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Friday, May 25, 2018

যেনে নিন ভয়ংকর কৌশল কি ফিরিয়ে আনবে যুক্তরাষ্ট্র?




বিশালদেহী জেরেমি সিভিটস হাঁটার সময় পিঠটা একটু কুঁজো হয়ে যায়। নিজেকে একটু ছোট করেই তুলে ধরতে চান তিনি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে জড়সড় হয়ে কথা বলছিলেন তিনি। তাঁর অতীতের অসম্ভব নির্মম এক গল্প আছে। যে গল্পের সঙ্গে এখন তাঁর আর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
সম্প্রতি সাবেক মার্কিন সেনা জেরেমি সিভিটসের একান্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় বিবিসি অনলাইনে। তাঁর সেই লজ্জাকর অতীতের অভিজ্ঞতা এতে তুলে ধরা হয়।
ইরাকের বাগদাদের আবু গারিব কারাগারে দায়িত্ব পেয়েছিলেন জেরেমি সিভিটস। সেখানে নির্যাতিত এক বন্দীর ছবি তুলেছিলেন তিনি, যে ছবি প্রকাশ পায় ২০০৪ সালের ২৪ এপ্রিল। অমানুষিক নির্যাতন চলছিল ওই বন্দীর ওপরএমন অবস্থায় তাঁর ছবি তোলেন জেরেমি। ওই ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর নিন্দার ঝড় ওঠে। আবু গারিব কারাগারে মার্কিন দখলদারি বাহিনী কর্তৃক বন্দীদের ওপর লোমহর্ষক অত্যাচারের কাহিনি উঠে আসে সবার সামনে। শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় জেরেমিকে।
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের শাসনামল থেকেই কারাগারটি নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করে। ২০০৩ মার্কিন বাহিনী ইরাকে আগ্রাসন চালায়। এরপর থেকে মার্কিন সেনারা কারাগারটিকে বন্দী নির্যাতনকেন্দ্রে পরিণত করে।
জেরেমি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের মার্টিনসবার্গের বাসিন্দা। কিছুটা গ্রামীণ অংশে বাড়ি জেরেমির, সেখানে তরুণদের জন্য খুব বেশি কাজের সুযোগ নেই। বাবা ডেনিয়েল সিভিটসের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন জেরেমি। ডেনিয়েল ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য দুবার পদকও পান। ১৮ বছর বয়সে মার্কিন সেনাবাহিনীতে নিজের নাম লেখান জেরেমি। ৮০০ মিলিটারি পুলিশে স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে পাড়ি জমান জেরেমি।
সাক্ষাৎকারে জেরেমি বলেন, ‘ওই সময় আমার মনে হয়েছিল যে বিশাল কিছু করতে যাচ্ছি।ইরাকে আসার পর বাগদাদে আবু গারিব কারাগারে নিয়োগ পান। সেখানে মিস্ত্রি ড্রাইভার হিসেবে ছিলেন তিনি। সে সময় নারী-পুরুষ শিশু মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার ইরাকি বন্দী ছিল কারাগারে, যাদের বেশির ভাগই নির্দোষ। কী ঘটছে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তাদের। বিভিন্ন অভিযানে তাদের তুলে আনা হয়। এই বন্দীদের কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ-পদ্ধতি ব্যবহারে অনুমোদন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
২০০৩ সালের নভেম্বর মাসের এক বিকেলে কারাগারের ভেতরে যান জেরেমি। ইভান ফ্রেডরিক নামের এক সহকর্মী সে সময় এক বন্দীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মূলত তিনিই জেরেমিকে তাঁর সঙ্গে যেতে বলেন। জেরেমি বলেন, ‘ভেতরে গিয়ে দেখি, হলজুড়ে বন্দীদের বিবস্ত্র করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ফ্রেডরিক তাঁর সঙ্গে করে নিয়ে আসা বন্দীদেরও সেখানে শুইয়ে দিলেন।চার্লস গ্র্যানার, ল্যান্ডি ইংল্যান্ডসহ বেশ কয়েকজন সেনা উপস্থিত ছিল সেখানে। তাঁরা বন্দীদের দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন, মশকরা করছিলেন।
হঠাৎ একজন বন্দীর দিকে নজর পড়ে জেরেমির, যাঁকে অসম্ভব শক্ত করে হাতকড়া পরানো হয়েছিল। হাতকড়ার কারণে তাঁর হাত নীল হয়ে গিয়েছিল। তিনি গ্র্যানারের উদ্দেশে বলেন, ‘ওর হাতই তো নষ্টই হয়ে যাবে।এরপর তাঁর হাতকড়া খুলে দেন তাঁরা। সময় গ্র্যানার জেরেমির হাতে ক্যামেরা তুলে দেন। মেঝেতে শুয়ে থাকা ওই বন্দীর মাথা এক হাত দিয়ে উল্টো করে তুলে ধরেন গ্রানার। আরেক হাত দিয়ে চেপে ধরেন বন্দীর হাত। ওই ভঙ্গিমায় গ্র্যানারের হাস্যোজ্জ্বল ছবি তোলেন জেরেমি।
নিজের কৃতকর্মের বিষয়ে জেরেমি বলেন, ‘সেখানে আসলে সবাই এসব কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। বিষয়টা এমন যে সবাই তো করে। আমি নই কেন? আমি প্রথমবার সেখানে যাওয়ার পরই ওই ছবি তোলার ঘটনাটি ঘটে। তবে সেটিই আমার শেষ ছিল।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম সিবিএস জেরেমির তোলা ওই ছবিসহ বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করে, যেখানে ফুটে ওঠে ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র। নির্যাতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসার পর অভ্যন্তরীণ তদন্তের নির্দেশ দেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। তদন্তে বন্দীদের ওপর করা সেনাসদস্যদের নির্যাতনের চিত্র ধারণ এবং সেই অপরাধ থামাতে ব্যর্থ হওয়ার দায়ে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় জেরেমিকে। মোট ১০ জনকে সাজা দেওয়া হয়। এর মধ্যে চার্লস গ্র্যানারের ১০ বছর, ইভান ফ্রেডরিকের আট বছর ল্যান্ডি ইংল্যান্ডকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরে ২০০৬ সালে ইরাকি কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করা হয় আবু গারিব কারাগার। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর ২০০৯ সালে নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়। সামরিক জিজ্ঞাসাবাদও সীমাবদ্ধ করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করা হয় এই অভিশপ্ত কারাগার। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, এই কারাগারে নির্যাতনে প্রায় চার হাজার বন্দীর মৃত্যু হয়েছে।
জেরেমি জানান, কারাদণ্ড ভোগের পর পেনসিলভানিয়াতে ফিরে আসেন তিনি। মার্টিনসবার্গে ফিরে কাজ খুঁজতে শুরু করেন তিনি। বর্তমানে নিজ আবাসস্থল পেনসিলভানিয়ার মার্টিনসবার্গে অনেকটানির্বাসিতজীবন কাটাচ্ছেন জেরেমি। কারও সঙ্গে খুব একটা মেশেন না।
দীর্ঘ সময় নিজেকে অসম্ভব বাজে মানুষ ভাবতাম আমি। নিজের প্রতি অসম্ভব ঘৃণা ছিল আমার। মিস্ত্রি হিসেবে কোথাও কাজ পাইনি’—এভাবেই নিজের কথাগুলো বলছিলেন জেরেমি পরবর্তী সময়ে কাউন্সেলিংয়ের কাজ শুরু করেন তিনি। মাদক মদে আসক্ত ব্যক্তিদের কাউন্সেলিং শুরু করেন।আবু গারিব কারাগারে আমার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম আমি। মানুষকে বেঁচে থাকার পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলাম।
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের নিজের ভুলের গল্পটা শোনান জেরেমি। আবু গারিব কারাগারে যা করেছেন, তার জন্য লজ্জিত তিনি। নিরপরাধ বন্দীদের সঙ্গে যা করা হয়েছে, তা ভয়াবহ ছিলএমনটা এখন বিশ্বাস করেন তিনি। তবে স্রোতের টানে গা ভাসিয়েছিলেন। বিবেককে কাজে লাগাননি বলে এখনো অনুশোচনায় ভোগেন জেরেমি।
তবে মানুষ হিসেবে আসলে কেমন জেরেমি সিভিটস? মার্টিনসবার্গের ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ় রবার্ট ক্লাইটস বিবিসির ওই প্রতিবেদককে বলেন, ‘জেরেমি খুব ভদ্র এক কিশোর ছিল। কেউ তার কাছে সাহায্য চাইলে সব সময় তাকে সাহায্য করত সে। আর দেখুন কী হয়ে গেল! তাকে কেউ কিছু করতে বলল। জেরেমি করল। আর ফেঁসে গেল বেচারা।

জেরেমি বলেন, ‘সেখানে যে অপকর্মের সঙ্গে আমি জড়িয়ে গিয়েছিলাম, তার জন্য আমি লজ্জিত। তা আমাকে এখনো তাড়া করে।জেরেমি একরকম স্বেচ্ছানির্বাসনে জীবন কাটাচ্ছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সব নাগরিক কি বন্দী নির্যাতনের বিষয়টিকে এভাবে দেখেন? বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, যাতে যাঁরা সরকার বা সামরিক কাজে নিযুক্ত, তাঁরা আরও দায়বদ্ধ থাকেন। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, মানুষ আগের চেয়ে বেশি নির্যাতনের ধারণাকে গ্রহণ করছে। আবু গারিবের নির্যাতন ভয়ংকর হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহতা কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে। অনেকে ওই নির্যাতনের ছবিগুলো প্রত্যাখ্যানও করেন। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকার দুই-তৃতীয়াংশ জনগণ জিজ্ঞাসাবাদে নির্যাতনকে সমর্থন করেছেন।
২০১৬ সালে বর্তমান ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বলেন, দায়িত্ব পেলে তিনি জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনের সেই পুরোনো কৌশলওয়াটারবোর্ডিংফিরিয়ে আনতে চান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সে সময় বলেন, তথ্য আদায়ের জন্য বন্দীদের নির্যাতন করা পুরোপুরি কার্যকর একটি প্রক্রিয়া বলে তিনি বিশ্বাস করেন। বারাক ওবামা ২০০৯ সালেওয়াটারবোর্ডিংবাতিল করেন। ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ সেনারা গত শতকের সত্তরের দশকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের কারাবন্দীদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতনমূলকওয়াটারবোর্ডিংপদ্ধতি ব্যবহার করতেন।ওয়াটারবোর্ডিংপদ্ধতিতে বন্দীর মুখ তোয়ালে দিয়ে ঢেকে নাক-মুখ দিয়ে পানি প্রবেশ করানো হয় এবং এর মাধ্যমে বন্দীর মনে পানিতে ডুবে মরার আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
তবে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর ট্রাম্প তাঁর অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসেন। নির্বাচনের পর প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস জানান, জিজ্ঞাসাবাদে নির্যাতন ফিরিয়ে আনার ধারণাটা মারাত্মক হবে। তবে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনওওয়াটারবোর্ডিংফিরিয়ে আনার পক্ষে ছিলেন।
নির্বাচনী ওই প্রতিশ্রুতি পূরণে এগিয়ে চলেছেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম গোয়েন্দাদের চালানোর দায়িত্ব পেয়েছেন কোনো নারী। বিতর্কের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে সিনেটের জিনা হাসপেল নিয়োগ পেয়েছেন। জিনা হচ্ছেন সিআইএর এমন কর্মকর্তা, যিনি ২০০১ সালের ঐতিহাসিক নাইন-ইলেভেনের পর মুসলমানদের গোপন কারাগারে নিয়ে নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের বিভিন্ন কলাকৌশল উদ্ভাবন করেন।
জিনা হাসপেলের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর সময় তথ্য বের করতে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ ছিল। ফরচুন ম্যাগাজিনের এক খবরে বলা হয়েছে, ২০০২ সালে থাইল্যান্ডে গোয়েন্দা সংস্থাটির এক গোপন কারাগারে চলা ধরনের কাজ তদারকি করেছিলেন জিনা। এমনকি নির্যাতনের প্রমাণও  নাকি লোপাট করেছিলেন। নিয়ে গত বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস। ধরনের নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জিনাকে সিআইএর ক্ল্যান্ডস্টাইন সার্ভিসের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিয়ে কখনোই প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি জিনা।


No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Responsive Ads Here