লোকটি হিন্দু কিন্তু ৭১ বছর বয়সী , তিনি ভারতের কলকাতার বাসিন্দা। গত ২১ বছর ধরে রমজানের সময় রোজা রেখে চলেছেনতিনি । অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিরুদ্ধে এটা তার ব্যক্তিগত প্রতিবাদ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষ হিসেবে লজ্জা প্রকাশ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের একজন মানুষ হয়ে কিছুতেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা মেনে নিতে পারছিলাম না। তখনই ঠিক করি আমি নিজেই প্রতিবাদ করব, বলেন সঞ্জয় মিত্র। অথচ এমন এক পরিবারের সন্তান সঞ্জয় মিত্র, যাদের বাড়িতে ১২৫ বছর ধরে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে।
রমজানের এক বিকেলে মগরিবের নামাজ শুরু হওয়ার একটু আগেই বাড়ি থেকে জিনস্ আর খদ্দরের ফতুয়া গায়ে বেরিয়ে কলকাতার মুসলমান প্রধান এলাকা রাজাবাজারের ঠিক যেখানে হিন্দু পাড়া শেষ হয়ে শুরু হয়েছে মুসলমান মহল্লা সেখানেই একটা মাঝারি মাপের খাবার দোকানে ঢুকতেই সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় হলো।
একটা টেবিলে বসতে বসতে মি. মিত্র বলছিলেন, ইফতারটা বেশির ভাগ দিনই বাড়িতেই করেন। তবে মাঝে মাঝে এই দোকানেও আসেন।
‘এই দোকানটায় আসছি প্রায় ৫৫ বছর ধরে। অনেক পাল্টে গেছে। এখানেই প্রথম গোরুর মাংস খেয়েছিলাম মনে আছে। আর তারপর থেকে তো নিয়মিতই খাই, হাসতে হাসতে বলছিলেন মি. মিত্র।
কথা বলতে বলতেই পাশের মসজিদে শুরু হলো মগরিবের নামাজ- আর ইফতার করে দীর্ঘদিনের চেনাপরিচিতদের সঙ্গে রোজা ভাঙ্গলেন সঞ্জয় মিত্র।
দোকানের মালিক মুহম্মদ নঈমুদ্দিন, এক কর্মী মুহম্মদ জমিরুদ্দিনের সঙ্গে একই প্লেট থেকে কলা, পাকা পেপে, শশা, খেজুর আর তরমুজ খাচ্ছিলেন মি. মিত্র।
এই হিন্দু বন্ধুর রোজা রাখাতে একটু অবাক নন মি. নঈমুদ্দিন। তিনি বলছিলেন, ‘প্রথম যখন শুনি যে মি. মিত্র রোজা রাখেন, শুনে খুব ভালো লেগেছিল যে, একজন মুসলমানের মতোই তিনিও রোজা রাখেন।
এরকম তো কোনো কথা নেই যে, রোজা শুধু মুসলমানরাই রাখতে পারবে। সবাই রাখতে পারে। হিন্দুরাও তো বিভিন্ন পূজার দিনে উপোস থাকে। আর আমাদের এটা এক মাসের উপোস- ব্যাপারটা তো একই।’
কখনো বাড়িতে ফল বা রুটি খেয়ে, কখনও বা হালিম খেয়ে গত একুশ বছর ধরে রোজা ভাঙছেন সঞ্জয় মিত্র।
খাবারের দোকানে আসার আগে বাড়িতে বসে মি. মিত্র বলছিলেন অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর প্রতিবাদ হিসেবেই রমজান মাসে রোজা রাখতে শুরু করেন তিনি।
‘বাবরি মসজিদের ঘটনা ৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। তখন আমি দিল্লিতে থাকতাম। উত্তর ভারতে তো ওই ঘটনার পরের দাঙ্গা অনেক বেশি হয়েছিল, সেই সময়ে খুব অসহায় লাগছিল- হিন্দু হিসেবে।
একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষ হয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তখনই ঠিক করি যে আমি নিজেই প্রতিবাদ করব- এককভাবেই,’ বলছিলেন সঞ্জয় মিত্র।
যদিও নিয়মিত ধর্মাচরণ করেন না মি. মিত্র। তবে মুসলমানদের ধর্মাচরণের একটা অঙ্গ- রোজা রাখা নিয়ে স্ত্রী প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাই বছরে আরও একটা মাস উপোস করেন তিনি- গ্রাম বাংলায় চৈত্র মাসের গাজনের সময়ে।
মি. মিত্রের কথায়, ‘কয়েক বছর রোজা রাখার পর আমার স্ত্রী বলেছিলেন, তুমি মুসলমানদের মতো রোজা রাখ, কিন্তু নিজের ধর্মের জন্য তো কিছু কর না। তখন আমি বলি যে নমশূদ্র- যারা বেশির ভাগই ভূমিহীন কৃষক, চৈত্র মাসে কোনো খাবার থাকে না বলে গাজনের নামে ভিক্ষা করে সন্ধ্যায় একবারই খায়- আমি সেটা করতে পারি। ভিক্ষাটা পারব না, কিন্তু গাজনের উপোস করি নিয়মিত। আমার উপোস রমজান আর গাজনের।’
নিয়মিত ধর্মাচরণ করেন না বলেই যেমন মন্দিরে যান না, তেমনি রমজান মাসে পাঁচবার নমাজও পড়েন না এক সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য আর মানবাধিকার কর্মী সঞ্জয় মিত্র। বছরের দুমাস উপোসের সময়ে তার সঙ্গী বই আর গান।
বামপন্থি আন্দোলনে যখন যুক্ত ছিলেন, তখন যদিও দাঙ্গার সময়ে মুসলমান মহল্লায় গিয়ে সবাই মিলে রাত জেগে পাহারা দিয়েছেন, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠরা যখন বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে, তার প্রতিবাদটা তিনি একান্তই নিজস্ব ঢঙে করে চলেছেন- কারণ সেই ছোটবেলায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গায় মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার স্মৃতিটাও তার একান্তই নিজের।
অসল কতা হলো নিজের ভিতরে সব কিছু চেষ্টা করলে সফল হয়।
No comments:
Post a Comment